তবু ফুলেরা হাততালি দেয়
নাফিউল হক নাফিউ
গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা মন্দির
পলিমাটির গভীরে ছিল এক মন্দির,
কালের প্রবাহে ডুবে গেছে তার স্মৃতি।
তবু আজ, গঙ্গার বুক ফুঁড়ে উঠে এলো—
স্তুপাকারে ধুলোমাখা প্রাচীন শিলালিপি।
পলাশের আগুনে ঝলসে যাওয়া গাছ,
শুনতে পায় সেথা ঢোল বাজানোর সুর।
ভাঙা মূর্তির চোখে শুকনো অশ্রু,
ভাসে মেঘলা দিনের ছেঁড়া পর্দার নীচে।
নৌকার মাঝি থামিয়ে দিল দোল,
জলে ঝরে পড়ল তার বর্শার ডগা।
মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সেখানেই যেন—
জেগে উঠল এক রক্তস্নাত যুগান্তরের কথা।
মন্দিরের দেয়ালে লেখা ছিল কাহিনি,
নির্যাতিত জনতার গর্জন আর কান্না।
কেউ জানেনি, কারা গড়েছিল এ মহাকাব্য?
কিন্তু আজ, তারা ফিরেছে গঙ্গার ঢেউয়ে।
তোমার শহর কি এই মন্দির দেখেছে?
নাকি, আবার মুছে দেবে স্মৃতির এই দাগ?
গঙ্গার স্রোতে মিশে যাবে কি সব কথা?
নাকি এইবার কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে
মাটির বুকের শপথ?
ভাঙা মাটির কলসি
জঙ্গলের নিস্তব্ধতা, বাঘের ডাক ঘুম কেড়ে নেয়
অরণ্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, আলোছায়ার খেলা—
মৃত্তিকার গন্ধ মিশে যায় বাতাসে,
অজানা পথের যাত্রীদের মনে কৌতূহল জমে।
তবু রঙিন পালকের পাখিরা গান থামায়
যখন বনান্তে এসে নামে ধূসর ধোঁয়া।
কারা যেন কেটে নিচ্ছে বৃক্ষের প্রাণ,
ভূমির গা বেয়ে রক্তের রেখা টেনে দেয় স্রোতহীন প্রাণ।
এক কোণে পড়ে থাকে ভাঙা মাটির কলসি,
একদা যা বয়ে আনত স্বচ্ছ নদীর জল।
শিশুদের দৌড়ানোর পথ আজ মিশে গেছে
ইটের গুঁড়ায়, নির্মমতার খেলার মাঠে।
জলহীন শিরায় মাটি চায় বারিধারা,
তবু আকাশ চুপ, চাতকের তৃষ্ণা পূরণ হয় না।
গাছেদের কান্না শোনা যায় নীরবে—
এক পশলা বৃষ্টি নয়, তারা চায় জেগে ওঠার দিশা।
সময়ের আয়না
পাহাড়ের বুকে জমে থাকা মেঘেরা আজ
ছুঁয়ে গেছে সমুদ্রের নীল ধ্যান।
পোড়া গন্ধে ভরে ওঠে রান্নাঘর,
তবু তরকারির লবণ কম কিংবা বেশি—
জীবনের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
ছোট্ট একটা চায়ের কাপে
ভেসে বেড়ায় অলস দুপুরের গান।
জীবনের গ্রীষ্ম বাগান ভরে রাখে
অপেক্ষার হলুদ পাতা।
ফুলেরা তবু হাততালি দেয়,
একদিন হয়তো শব্দেরা ফিরে আসবে,
রং পাবে,
আর আয়নার মতো সময়
ধরে রাখবে সেসব মুহূর্ত।
মাটির আঁচল
অতীতের পাতা উল্টে, জেগে থাকা ধূসর দিনগুলি,
যে-কোনো পাগল রাতে, যেন শূন্য আকাশে ছড়িয়ে যায় কোন রূপহীন ছায়া,
আমি চুপচাপ ভাবি, এই আমি কি শুধুই এক দুরন্ত পথিক—
পথ যার শেষ নেই, তার সীমানা চিরকাল অজ্ঞাত।
তুমি বলেছিলে, জীবন— একটি সন্ধ্যায় হারানো স্বপ্নের মতো,
যে স্বপ্নটি সূর্য ডুবে যাবার পর, কোথাও না কোথাও চুপিচুপি হারায়।
সব কিছু যেন ঘোরপ্যাচে বাঁধা,
মনের পাতায় লিখিত ভুল চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে,
এখন ভাবি— যে নদী একসময় ঢেউ খেয়ে হারিয়ে যায়,
সেই নদী কি আদৌ ফিরে আসে?
যতদিন তাকাই, মাটির আঁচলে ধ্বংসের কোনো আভাস দেখি না,
পাশে শুধু পুরানো বাড়ি, ঘরবাড়ি হয়ে গেছে ধুলোর আবরণ—
শুধু ভেসে থাকে কিছু নির্জন কষ্টের প্রতিচ্ছবি,
যাদের দেখা পাই আমি দিনের শেষে, নিঃশব্দে…
আমরা স্রোতের কচ্ছপ
অজ্ঞাত পথের শেষে, যে পথটি হারিয়ে গেছে মেঘের মধ্যে,
আমি গিয়ে দাঁড়াই, এক মৃত পাহাড়ের কোলে, যেখানে কাঁপছে বাতাস,
তারপর, ভুলে যাওয়া ছায়ার মতো, অবশিষ্ট থাকে কিছু ভুল নাম।
এখন সেই নদী, যা ছিল সোনালী আলোর খোঁজে,
আজ নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছে, অন্য কোনো দিগন্তের জন্য অপেক্ষা করছে।
তুমি কি জানো, আমি শৈশবের কোনো খেলনা,
যা পাখির পাখায় চড়ে, রক্তিম সুরে মিলিয়ে যায় একদৃষ্টিতে?
তখন, তুমিই বলেছিলে— আমরা স্রোতের কচ্ছপ, বেঁচে আছি কোনো মাটির ঘ্রাণে,
এখন সেই লতা, যা ছিল একদিন বেঁধে,
আজ ভেঙে গেছে; জলপথে ফোটে সেই অদৃশ্য ফুল।
আমরা কিছু খুঁজছি, কিছু হারাচ্ছি,
স্রেফ, এই পথের শেষে, নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি—
হয়তো, কেউ আর জানে না কোথায় বেঁচে আছি, কোথায় হারিয়ে যাব।
সলিলের সঙ্গীত
চিরন্তন পাহাড়ে পাথরের আঁকা ভোর
পাথরসাথি তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে,
একদিন যদি সমুদ্র ঢালতে পারতাম
তবে হয়তো জানতে পারতাম,
কিভাবে নদী তার সবুজ কাঁপনে
ছড়িয়ে দেয় সলিলের সঙ্গীত।
আর নিষ্পলক জল পায় ভাবনা… তার শান্তি,
অন্তর্দৃষ্টি, ঢেউ, শান্তি সোনার বালিতে বালি-চলে
কিভাবে মিশে যায়!
কেন মনে হয় প্রতিটি ঢেউ চড়ে গেলে
চলে যায় একটু করে পানির স্পর্শ?
যে ভাটির শব্দ ফিরে আসে না—
তার জন্য আমি জানি না একটি সমুদ্রের ছায়া!
বড়ো খুকি
বড়ো খুকির চুলে বেলের গন্ধ, তার সাথে দেখা হয়েছিল এক বৃষ্টির বিকেলে
গোলাপের মধ্যে খোঁজ করেছিল আমি, এক উড়ন্ত মাকড়সার জাল হাতে।
তার পরের বছরই আমরা নেমেছিলাম স্কুলের মেঝেতে, চিরকাল থমকে থাকা
দরজার ওপাশে কেটেছে তার হাসি, মাটির নিচে খুঁজে পাওয়া যাবে না কখনো
তিনটি প্রজাপতির সাঁকো।
বড়ো খুকি এখন পিতার চুলে স্নান করে, সে জানে না কখন ঘর ভেঙে
চলতে চলতে নতুন বাড়ির চিরকালীন ঢেউ। সবুজ ঘাসের পাশে এসে দাঁড়ায়
তাকে ডাকলেই ফিরে আসে আরেক বেলা, মা যা হবার হবে— দুষ্টুমি জানে না।
তবে আজও সে দেখেনি, কোনও মেঘের ছবি ছাড়াই উড়ে যাওয়া পাখি।
এখন মা–এর মাঝে এত পৃথিবী, তার ঘরের ঝাঁকি সুর, আমার চোখের ঝিলিক
আমিও সেই পাখি, নীল আকাশে আঁকা ছায়া।
সব তার পায়ের নিচে শব্দের খেলা, ফিরিয়ে দেওয়া আলোর রূপরেখা,
আর আমি একা কখনো ফিরে যাব, বড়ো খুকির কোথাও নেই পথ!
ছাই
তুমি জানো সেই নির্জন গলি, এক টুকরো মেঝে, সিঁড়ির কোণায় রাখা এক আধখাওয়া পাখি। আমি প্রতিদিন গলির মেঝেতে চুমুক দেওয়া নোনা জল খুঁজি বৃষ্টির মিষ্টি গন্ধ! শুকনো পাতাগুলো উপরে পড়ে থাকে এক অবশ চাঁদের মতো। সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে যে কুকুরটা, তার চোখে জ্বলন্ত লাল রঙের চুম্বক—এখানে রাস্তা চলে গেলে সে আগুনে পুড়ে সৎকার হবে— হয়ে যাবে ফিনিক্সের পালক… মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া একটা জেলের আঙুলে লুকিয়ে থাকে কবরস্থানের নাম—এক বিশাল ঝর্ণার নৈঃশব্দ্য, অথবা শুকনো গাছের বাকরূদ্ধ স্তব্ধতা! তোমার হাতে তখনো থাকবে সেই ধূসর রুমাল, একা একা চিমটে চিমটে ঝরে যাবে রাতের সময়!
মানুষ
যে হৃদয় রক্তে রাঙানো, তার গন্ধও অন্যরকম, এ হৃদয় নিঃশেষ হয়ে থাকে সবুজ পাতায় শীতল পরশে এক মহাকাব্য রচনা করে, যা গোধূলির আলোয় ঝরে পড়ে!
চোখ আর মুখেরও এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে, কথায় ও হাসিতে সমান্তরাল হাত ও পায়ের মতো সম্পর্ক দুইয়ের সেতু— তবে নিঃশব্দ লাঠির মতো গলা, যা কখনো বল না বলে এরা সকলেই মাঝে মাঝে হাসে, কখনো থেমে যায়—একা এক মুহূর্ত হয়ে উঠতে চায়, সেই এক দিন, যেখানে কলাপাতা শুয়ে থাকে, গাছের জন্যে কিছু বাঁচানো থাকে, হৃদয়ের মতো।
শরীরটা মাটির ঘ্রাণে ভরে, শব্দ ও ছায়ায় মিলিয়ে, এক নতুন উদ্ভাবন বলে— হৃদয়টাকে সরিয়ে রেখে যদি চিন্তাশক্তির জমিনে ছড়িয়ে দাও,
তবে সেখানে সব কিছু বদলে যাবে, অনেক কিছু থাকবে এক সুরে!
ইটের গন্ধ
পুরোটা আকাশের তলায় তোমার নামে ভাসানো মেঘ, মেঘে নক্ষত্রের সুর খোঁজা— ঘুমের মাঝখানে এক খোলা জানালা। তার ওপারে জলাশয়ের গন্ধ, শালুকের পানিতে ভেসে আসা মুদ্রা, শুনতে পাই সেঁচে ওঠা বাঁশির সুর— তোমার পদধ্বনি শোনা যায় বেতনের নিচে। গাছের পাতা কাঁপে, ধূলির ঝড়ও ভেসে যায় এখানে, ছোট ছোট শূন্যতাগুলোতে জীবন ফিরে আসতে চায়। শূন্যতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে চিরকালীন শব্দ— তোমার মধুর হাসি। প্রতিটা আলোর আঁচল যেন পরীর ঘুম, গভীর গহিনে ছায়ার খেলা। মনে হয়, কোনো অনবদ্য পাখি পাখার সাথে আমাদের আঙুলের ছোঁয়ায়। তোমার চোখের ঝিলিকের মতো নৈঃশব্দ্য পুরানো স্মৃতির মতো টেনে আনছে আমায়— কোনো এক সরল রেখায় ভাসতে থাকা ইটের গন্ধের স্নিগ্ধতা!
এই পৃথিবী আমাদের নীরব গল্পের মতো, ধীরে ধীরে একে একে স্বপ্ন হতে আসবে, মুছে যাবে—
যেখানে তুমি, সেখানে আমার ছোট্ট সমুদ্র।