ইঁদুরখালের ধান
আনিফ রুবেদ
ধান কাটা হয়ে গেছে। কেটে নেয়া ধানগাছের গোড়াগুলো জমির গায়ে লেগে আছে বাঘ-শেয়াল-সিংহের থাবার মতো। গোছা গোছা কাঁটার মতো ধানগাছের গোড়ালি।
ধান কাটা হয়ে গেছে আর আটিবাঁধা ধান নিয়ে চলে গেছে যার যার ধান। জমিতে ছোটো ছোটো সোনার কুচির মতো ঝরা ধান পড়ে আছে। সোনালি পোকার মতো কোনো কোনো ধান ছোটো ছোটো গর্তের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে। সোনার মতো ধান জমির ওপর বসে থেকে হাসছে। ধানগাছের গোড়ালি, ঝরে পড়ে থাকা ধান আর ধানী জমি ধীরে ধীরে কথা বলে।
এসব ঝরা ধান, ধানী জমি, কুটো খড়ের সাথে কথা বলতে বা এদের কথা শুনতে বা এদের কথামালার বিচ্ছেদ ঘটাতে ওরা আসছে। ওরা চারজন।
সোনালি পোকার মতো ধান টুকতে টুকতে তাদের একজন ওঠে। একটা আলের ওপর দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে একটা ইঁদুরখালের মুখ লক্ষ করে মুততে শুরু করে। ধান খুটা বাদ দিয়ে অন্যরা তার মুতা দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে।
‘উঁহ্, তোর মুতে তো খুব ঘিনঘিনে গন্ধ রে রমজান’ বলে মুখটাকে হাস্যকরভাবে বিকৃত করে রমেলা। রমেলার বিকৃত মুখ দেখে হি হি করে হেসে ওঠে কুরবান। রমেলাও হেসে ওঠে। তাদের হাসি শুনে তাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে মূত্ররত রমজানও হাসে।
ওদের আসা শেষ হলে বোঝা যাবে আরও কী ঘটতে যাচ্ছে। এই ফাঁকে কয়েকটি ইঁদুর খাল থেকে বেরিয়ে সোনার কুচিগুলোকে তাদের সাদা দাঁতের সাথে সহবাস করার লোভ দেখায়। জমিতে বসে হাসতে থাকা সোনালি পোকার মতো ধানগুলো ইঁদুরের সাদা দাঁতের প্রেমে পড়ে। কিছু ধান মাটির আড়ালে গা ঢাকা দেবার চেষ্টা করে। কোনো কোনো ধান পরিত্যক্ত গোড়ালিগুলোর ভেতরেই মাথা লুকিয়ে আছে।
ওরা হেঁটে আসে আর ওদের হেঁটে আসা স্পষ্টভাবে ইঁদুরদের বলে দেয়, ‘তোমরা খালের ভেতর ঢুকে যাও, ধানের সাথে সহবাস বন্ধ করো।’ তাদের হেঁটে আসা হয়তো একথা বলে না। তাদের হেঁটে আসার শব্দ হয়তো শুধু ভয় দেখায়। বা ভয়ও দেখায় না। তবু ভয় পায় ইঁদুরেরা। ভয় পেয়ে গর্তে ঢুকে যায়। গর্তে গতর ঢুকিয়ে দেবার পর মুখ বের করে স্বচ্ছ চোখে তাকায়। স্বচ্ছ চোখে তাকিয়ে দেখে, মানুষের বাচ্চারাকে, জগতের একমাত্র হিংস্র জীবের বাচ্চারাকে।
মানুষের ছোটো ছোটো চারজন বাচ্চা আলের ওপর পা ছড়িয়ে বসে। তারা ছোটো ছোটো করে কথা বলে আর ঝরা ধান তাকিয়ে দেখে। একেকটা ধান একেকটা চালের বস্তা। একটা সোনালি বস্তার ভেতর একটা সাদা চাল রাখা আছে। এসব চাল মানুষে খায়।
তারা ধান কুড়ানোর জন্য এসেছে। এরা বসে বসে ছোটো ছোটো সোনার কুচির মতো ধান খুঁটতে লাগল। সোনার কুচি টুকে টুকে কাপড়ের ব্যাগে ঢুকায়।
অন্ধকার নামল। ঘন অন্ধকারে কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুকে পার্থক্য করা যায় না। শুধু একটা করুণ কান্না ভেসে আসছে। কোনদিক হতে ভেসে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। পুব দিকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমে পাতলেও। উত্তর দিকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, আবার দক্ষিণেও।
সোনালি পোকার মতো ধান টুকতে টুকতে তাদের একজন ওঠে। একটা আলের ওপর দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে একটা ইঁদুরখালের মুখ লক্ষ করে মুততে শুরু করে। ধান খুটা বাদ দিয়ে অন্যরা তার মুতা দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে।
‘উঁহ্, তোর মুতে তো খুব ঘিনঘিনে গন্ধ রে রমজান’ বলে মুখটাকে হাস্যকরভাবে বিকৃত করে রমেলা। রমেলার বিকৃত মুখ দেখে হি হি করে হেসে ওঠে কুরবান। রমেলাও হেসে ওঠে। তাদের হাসি শুনে তাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে মূত্ররত রমজানও হাসে। তারা চারজন হি হি করে হাসে। তারা তাদের হাসি দেখে আরো আরো হাসে। তাদের হাসিধনে বাতাসের কোণাকাঞ্চি ভরে ওঠে।
মুতা শেষ করে রমজান আবার এসে বসে তার জায়গায়, রমেলার পাশে। ধান টুকতে শুরু করে।
বসতেই রমেলা টিপ্পনী কাটে, দুষ্টুমি করে- তোর নুনুটা তো বেশ রে রমজান, আতরের মতো মুত বেরোয়।’
বলেই রমেলা হেসে ওঠে, সাথে সাথে সকলে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে তারা সোনাপোকা ধান কুড়ায়। তারা ধান কুড়ানোতে আরও গতি তৈরি করে। ছোটো ছোটো ছড়ানো ছিটানো ধান তাদের হাত আর চোখের সহযোগিতায় ছোটো কাপড়ের ব্যাগে উঠে আসে।
একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে আসে খুব নরমভাবে। তারা ধান আর ধানের গোছা আর ধানের জমির কোনো পার্থক্য করতে পারে না। ধান আর খুদে খুদে মাটির ঢেলার পার্থক্য করতে পারে না। তারা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ধানপূর্ণ ছোটো ছোটো কাপড়ের ব্যাগের মুখে গিঁট দিয়ে বেঁধে ফেলে। ধান তো পালিয়ে যাবে না তাহলে তারা ব্যাগে গিঁট মারে কেন, এ প্রশ্ন নিয়ে ব্যাগের ভেতর ধানেরা ফিসফিস করে কথা বলে। পাল্টা ফিসফিস হয়, তারা ব্যাগের মুখে গিঁট দেয় এই কারণে যে, তাদের নিজেদের ওপরে নিজেদেরই বিশ্বাস নেই, যে কোনো সময় উচোট খেয়ে পড়ে যাবে এই ভয়ে। মানুষ কোনো জীবকেই বিশ্বাস করে না, মানুষ কোনো মানুষকেই বিশ্বাস করে না, মানুষ নিজেকেও নিজে বিশ্বাস করে না। ধানেরা মানুষ নিয়ে, ইঁদুর নিয়ে, শালিক নিয়ে, জমি নিয়ে কথা বলতেই থাকে।
তারা উঠে আসে চওড়া আলের ওপর। চারজনেই একসাথে মুততে বসে। সারি বেঁধে মুততে বসে।
মুততে মুততেই রমজান মুত্ররত রমেলার দিকে তাকিয়ে বলে- তোর মুতে তো ঠিকই আতরের গন্ধ রে রমেলা। আল্লার কসম তোর মুত থেকে সত্যি সত্যি আতরের গন্ধ বের হচ্ছে।’
রমেলা হাসে, কুরবানও হাসে, সকলেই হাসে। হাসতে হাসতে একে অপরের মুতের উপর গড়িয়ে পড়ে। তারা তাদের নিজেদের মুতের ওপর গড়িয়ে পড়ে, মুতের গায়ে তাদের হাসি লেগে যায়। পরস্পরের মুতে পরস্পরের গা মাখামাখি হয়ে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
একজন বলল- ’এবার চল ফিরে যায়।’
‘চল যায়।’
তারা সন্ধ্যাকে লাত্থি মারতে মারতে ফিরতে থাকে।
ফেরা শেষ হলে। তারা চারজন চারটা ইঁদুরের খালে ঢুকে যায়।
তাদের যখন ফেরা শেষ হয়েছে তখন তারা অনেক বড় হয়ে গেছে।
অন্ধকার নামল। ঘন অন্ধকারে কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুকে পার্থক্য করা যায় না। শুধু একটা করুণ কান্না ভেসে আসছে। কোনদিক হতে ভেসে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। পুব দিকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমে পাতলেও। উত্তর দিকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, আবার দক্ষিণেও।