শুক্রবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৫

প্রতিকৃতি ও আত্ম-প্রতিকৃতি’র নান্দনিকতা

প্রতিকৃতি ও আত্ম-প্রতিকৃতি’র নান্দনিকতা

মো.শেখসাদী ভূঁঞা

যুবক রাজা তুতেনখামেনের স্বর্ণ নির্মিত প্রতিকৃতি ভাস্কর্য খ্রি.পূ. ১৩৫৫-১৩৪২ ইজিপশিয়ান জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ১৯৯২ সালে তার সমাধিসৌধ খনন করে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। সে সময়ে অভিজাত শ্রেণির সমাধীসৌধ চোখ ধাঁধাঁনো সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ছিল। একটির ভিতর অনেকগুলো কফিন । সবশেষ কফিনটি ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের। কফিনের ঢাকনার ওপরে ছিল রাজার প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। আভিজাত্যের নিদর্শণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল স্বর্ণ ও লাপিজ লাজুরি দামি পাথর। প্রতীক হিসেবে প্রতিকৃতিতে উচ্চ মিশরের শকুন ও মিশরের সর্পদেবীর প্রতিকৃতি। পোষাকেও ব্যবহার করা হয়েছিল দামি সামগ্রি। প্রতিকৃতিটি ভীষণ ডেকোরেটিভ উচু নাসিকা, যুগল চিবুক, হরিণ টানা বোরো ও টানা টানা প্রসারিত চোখযুগল প্রথম পলকেই সবার মনকারে। এভাবেই রাজ-রাজারা তাঁদের স্মরণীয় করে রাখতেই প্রতিকৃতি নির্মাণের প্রচলন বহু যুগ যুগ ধরে করে আসছে। প্রতিকৃতিশিল্প এবং দু:শাসন দ্বৈতভাবে সভ্যতা বিকশিত হয়েছে।
প্যারাগুয়ে জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত আছে Head of a Celtric deity-Limestone. 2nd century BC. এই প্রতিকৃতিটি একেবারেই প্রাথমিক ভাস্কর্য নির্মাণ শৈলী।এই প্রতিকৃতি ভাস্কর্যে মুখমণ্ডল গোলাকৃতি, কুকরানো চুল, পেচানো গোফ, গোল গোল নয়ন জোড়া, গোফের মধ্যে একটি ফুটো,নাসিকা ছোট গলা বন্ধনীসহ সমগ্র প্রতিকৃতিটি সামান্য কমলা লেবুর আকৃতির। কাচা হাতে শিল্পী নির্মাণ করেছে। কিন্তু কালের বিচারে এর গুরত্ব অনেক। ওলমেক সংস্কৃতি ১৫০০-৮০০ খৃ.পূ. বিশালাকৃতির ওলমেক সংস্কৃতির ব্যাসল্ট-র ‘মুখমণ্ডল ভাস্কর্যটি মেক্সিকোর। এই বিশাল শিশুসুলব মুখাবয়বটি আস্ত একখণ্ড পাথর সামান্য ত্রি-মাত্রিক রিলিফ সরল রূপে নির্মাণ করা হয়েছে। এই সরলতার মধ্যে একধরণের চিন্তামগ্নতা প্রকাশের চেষ্ঠা করা হয়েছে। এটি দেখে বলা যেতে পারে মুখাবয়ব নিমার্ণের চেষ্টা মানুষ অনেক আগে থেকেই করে আসছে।




প্রতিকৃতিটি যে কোন দর্শককে প্রথম ফলকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিবে। রোমের জনৈকা তরুণ ‘মহিলা কবি ‘ এই শিরোনামে দৃষ্টিনন্দন ফ্রেস্কো প্রতিকৃতি পম্পেইয়ে প্রাপ্ত। জ্যামিতিক নকশা করা রঙিন টুপি ও সবুজ গ্রাউন্ড, কাধেঁ উত্তরীয় পরিহিত কবির অসাধারণ এই প্রতিকৃতিটি একদৃষ্টিতেই সবার নজর কাড়ে




‘অন্তোষ্টি মুখোশ স্বর্ণ, মাইসিনের রাজ সমাধী থেকে প্রাপ্ত, ১৫০০ খ্রি.পূ. ন্যাশনাল মিউজিয়াম, এথেন্স। ইজিয়ান সভ্যতায় অসংখ্য যুদ্ধ ও বীরত্বের কাহিনী তাকে অমরত্ব করে রেখেছিল হোমার রচিত ইলিয়াড ও ওডেসি মহাকাব্যে। তারা ছিল মূলত যোদ্ধা জাতি, গ্রিসে তৈরী করেছিল প্রাসাদ ও দুর্গ। এই স্বর্ণপাত পিটিয়ে পিটিয়ে নির্মিত হতো মুখোশ। অনুমান করা হয় রাজ-রাজন্য মৃত ব্যক্তির মুখ ঢাকার কাজে এই স্বর্ণের মুখোশ ব্যবহার করা হতো। এভাবে একদিকে যেমন সব ধরণের জাগতিক সর্ম্পক ছিন্ন করে অন্য বিবেচনায় মূল্যবান ধাতব বস্তু ব্যবহারের মধ্যদিয়ে আভিজাত্যকে শৈল্পিক রূপে স্মরণীয় করে রেখেছে। হেলমেট মেকার, ব্রোঞ্জ,খ্রি.পূ ৭০০, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম নিউইয়র্কে সংরক্ষিত আছে। এই ভাস্কর্যটি শিল্পী অন্য-একজন পেশাদার শিল্পীর নগ্নগায়ে মাটিতে বসে একাগ্র দৃষ্টিতে কর্মরত একটি শিশুর মুখমণ্ডল গড়নে ব্যাপ্ত। এই ভাস্কটির কম্পোজিশন এবং রাফসাফের্স শিল্পী নিখুত পর্যবেক্ষণে মডেলিং ও কাষ্টিং-এর মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে। কর্মরত শিল্পীর দৈহিক অভিব্যক্তির মধ্যে প্রথম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে। একজন দাসশ্রমিক শিল্পী হিসেবে নিজের আত্ম-প্রতিকৃতির দৃশ্যবোধয় এটিই প্রথম। এরআগে কখনোই এমন দৃশ্য দেখা যায়নি।
‘সেনমট উইথ প্রিন্সেস’ খ্রি.পূ.১৪৫০, বুযাক স্টোন স্ট্রালিসে মিউসেন বার্লিন। এই পাথরের প্রতিকৃতিটির মধ্যে চোখ ধাঁধাঁনো কম্পোজিশন। শিল্পী একটি ফিগার জোড় পায়ে বসা, কোলে একটি শিশুর শুধু মুখ কম্পোজিশনটি দৃশ্যায়িত করেছে হঠাৎ দূর থেকে তাকালে মনে হতেপারে লোকটির দাড়িওয়ালা সামনে দুখানি পা হাঠু উচুঁকরে জোড় পায়ে বসে আছে। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে মনে হবে একটি চৌকু-বেদীতে মস্তকটি রাখা হয়েছে। প্রতিকৃতিটি যে কোন দর্শককে প্রথম ফলকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিবে। রোমের জনৈকা তরুণ ‘মহিলা কবি ‘ এই শিরোনামে দৃষ্টিনন্দন ফ্রেস্কো প্রতিকৃতি পম্পেইয়ে প্রাপ্ত। জ্যামিতিক নকশা করা রঙিন টুপি ও সবুজ গ্রাউন্ড, কাধেঁ উত্তরীয় পরিহিত কবির অসাধারণ এই প্রতিকৃতিটি একদৃষ্টিতেই সবার নজর কাড়ে। কবি চরিত্র বুঝানের জন্য শিল্পী ডান-হাতে একখানি সরুকলম আলতোভাবে চিবুকে ঠেকিয়ে কি যেন কল্পনা… করছে অন্য-হাতে একখানি মেরুন রঙের ডাইরী। প্রতিকৃতিটি খুবই বাস্তবধর্মী। এভাবেই শিল্পীরা যুগে যুগে প্রতিকৃতি নির্মাণের বাস্তব কলাকৌশল ও বিভিন্ন মাধ্যম রপ্ত করতে থাকে।
Head of Darius from the Alexander-musaic, 330-300, house of the faun, pompeii. মাঙ্কি ক্যাপ পরিহিত আলেকজান্ডারের মোজাইক প্রতিকৃতিটি রঙিন ছোট ছোট টাইলস পাথরে গায়ে জড়ানো জামার প্রতিটি ঢেউ খেলানো ভাজঁ কাপড়ের নকশা ও অলংকার অসাধারণ নিপূনতার সহিত ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী সক্ষম হয়েছেন। এই প্রতিকৃতি নির্মাণের মাধ্যমে আলেকজান্ডারের যুদ্ধ-বীরত্বের শৌর্য ও বীরত্বকে চির স্মরণীয় করে রেখেছে।
গ্রীক নারীমূর্তি,খ্রি,পূ.-৪র্থ শতক, মাটি ওপর রঙের প্রলেপ। মাটির তৈরী দেহ জড়ানো শাড়ী পরিহিত পূর্ণদেহ নারীর মাথায় একটি সার্কেল নতোমস্তিকে দাড়ানো। মাটির ওপর বর্ণলেপনে প্রতিকৃতিটি কমনীয় দেহসৌষ্ঠব ও কমনীয় দৃপ্তি মডেলিংয়ের সাহায্যে নিখূতভাবে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছে। প্রতিকৃতিটিতে ধর্মীয় অনুভূতির আভাস পাওয়া যায়। ‘পোট্রেট অব লেডি’ খ্রি. ৯০. মিউজিও ক্যাপিটোলিনো, রোম, মার্বেল। ফ্যাশন সচেতন সুন্দরী রমনীর মার্বেলের ভাস্কর্যটি রোমান মাস্টার পিস হিসেবে স্বীকৃত। সমস্ত মস্তক জোড়েই পেচাঁনো চুলের রিং। রূপ-সজ্জায় আভিজাত্য এবং মশ্রিণ মার্বেল পাথরে দৃপ্তিময় চেহেরা সবকিছু মিলেমিশে হৃদয়গ্রাহী আবেদন, ভাস্কর সুক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।




‘হেড অব দ্য রোমান’, খ্রি.পূ ৮০, মার্বেল, পালাজো টোরলোনিয়া, রোম। প্রজাতান্ত্রিক সময় কালের এই আবক্ষ ভাস্কর্যটি লাইফ সাইজের মার্বরের তেরী। সে সময়ে হুবহু অনুকৃতি রূপায়নের প্রচলন ছিল। শিল্পী প্রতিকৃতির প্রতিটি কুঞ্চিত ভাঁজ ও অভিব্যক্তি যতাযথ কাভিং-এর মাধ্যমে দক্ষতার সহিত নিখুতভাবে ফুটিয়ে তুলছেন।




উইংড্ হিউম্যান হেডেড বুল- খ্রি.পূ. ১৯৫০-১৮৫০,লাইমস্টোন ,ল্যুভ ফ্রান্স। ভাস্কর্যটি মানুষের মুখমন্ডল যুক্ত ষাড়ের মতো পশু আকৃতির। সামন থেকে দৃঢ়-দন্ডায়নমান,পাশথেকে পা পাচঁটি ক্ষুরসমেত এবং চলমান।যে কোন দিক থেকে পা চারটিই মনে হবে । আবার পাশ থেকে মনে হবে চৌক আকৃতির লাইমস্টোন কেটে কেটে বুল এর শরীরের ওপর অংশ থেকে ওরন্ত পালক, বেনীপাকানো চুল ও দাড়ি মাথায় হৃদমিক ডেউ খেলানো টুপর,গলায় মালা পেশীবহুল দেহ সবকিছ’ মিলিয়ে রূপ গড়নে ভাস্কটি সিংহের মতো এক বিশাল শক্তিমান ও রাজার অমিত তেজ এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতীক। শিল্পী মেধা ও মননে সৃজনশীল ম্যজিকাল চলমান রূপ দিয়েছে। সকল অপশক্তির হাত থেকে এসেরীয়দের রক্ষা করবে স্পষ্টতই যেন এই অঙ্গীকার ভাস্কর্যের গড়নে। উল্লেখ্য যে দিব্যদর্শন মানুষের প্রাণি নির্ভরতারই প্রতীক। দ্বিতীয় সারগনের প্রাসাদে সম্মুখে ছিল এই ভাস্কর্যটি।
‘হেড অব দ্য বুদ্ধা,’ খ্রি. ৪র্থ-৫ম শতাব্দী, লাইম ব্লাস্টার ও পিগপেইন্ট,প্রাচীন গান্ধারা, ভিক্টোরিয়া এন্ড এলবার্ট মিউজিয়াম লন্ডনে-এ সংরক্ষিত আছে। মিশর,গ্রীক ও রোমান’রা যেমন দেবতা ও বীরযোদ্ধার আদর্শ ভাস্কর্য তৈরী প্রচলন ছিল ঠিক তেমনি ভারতীয় শিল্পেও তার প্রভাব পরেছিল। গান্ধারা থেকে প্রাপ্ত ধ্যানী বুদ্ধের নীলিমিত জোড়া চোখ দুটি মায়াবি ও আকর্ষণীয়। মাথায় ঢেউ খেলানো চুলের ভাজ, চেহারায় ভক্তিময় আকর্ষণ। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর অনেক হৃদয় বিধারক পূর্ণদেহ ভাস্কর্য ও পেইন্টিং শিল্পীরা বহু নির্মাণ করেছেন । ‘হেড অব দ্য রোমান’, খ্রি.পূ ৮০, মার্বেল, পালাজো টোরলোনিয়া, রোম। প্রজাতান্ত্রিক সময় কালের এই আবক্ষ ভাস্কর্যটি লাইফ সাইজের মার্বরের তেরী। সে সময়ে হুবহু অনুকৃতি রূপায়নের প্রচলন ছিল। শিল্পী প্রতিকৃতির প্রতিটি কুঞ্চিত ভাঁজ ও অভিব্যক্তি যতাযথ কাভিং-এর মাধ্যমে দক্ষতার সহিত নিখুতভাবে ফুটিয়ে তুলছেন। ভাস্কর সাবধানতার দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপকে অনুকৃতি করাই ছিল সাধনা ও নিষ্ঠা। এই সুপাররিয়ালিজম ছিল ধর্মীয় আবেগ তারিত। এখানে সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্বের চেয়ে বাস্তবানুগ, ভাবাদর্শ এ অভিব্যক্তিবাদই ছিল রোমানদের আদর্শ।
Prince Rahotep and his wife Nofret, furth Dynasty. 2613-2494. BC. painted limestone, Cairo Museum. প্রিন্স রাহুতেপ ও তার স্ত্রী নোফ্রেট পাশাপাশি একই ধরনের দুটি সাদা রঙের পাথরের সিংহাসনে বসে আছেন, দু’জনেরই সমান উচ্চতা, পিছনে সূর্য প্রতীক এটন। প্রিন্স খালিগায়ে মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাতের একটি পাজরে ওপর অন্যটি উরু স্পর্শ করে রাখা, পা দুটো হাঠু নীচে সুজা করে সম্মুখপানে তাকানো। স্ত্রী নোফ্রেত সুডৌল বক্ষ অর্ধ উন্মোচন অবস্তায় এর নীচে জোড়-বন্ধ হাতে ববকাট চুল মাথায় বন্ধনী,গলায় প্রসস্তমালা যৌবনের দৃপ্তিময় রূপ ত্রি-মাত্রিক ভাস্কর্য পেইন্ট করা। কালার কম্বিনেশন অসাধারণ। শিল্পী ভাস্কর্য দুটি তুলনাহীণ রূপদান করেছে।

(চলবে…)

লেখক পরিচিতি

এ বিভাগের আরও লেখা

ফেসবুক পেইজ

বিজ্ঞাপন

spot_img

জনপ্রিয় লেখা

ফিলিস্তিন

তবু ফুলেরা হাততালি দেয়

মধুপুর যেতে যেতে

বেলা শেষের দর্শন