প্রতিকৃতি ও আত্ম-প্রতিকৃতি’র নান্দনিকতা
মো.শেখসাদী ভূঁঞা
সারসংক্ষেপ: নন্দন শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে উদ্ভূত নন্দন শব্দের অর্থ কোন কিছু প্রত্যক্ষকরণ । “হেগেল মনে করতেন – শিল্প হলো অ্যাবসোলুটের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ”। মিশরীয় সভ্যতা এখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের। তাদের ধর্মবিশ্বাস ছিল হাজার বছর পরে হলেও একদিন মৃত মানুষ প্রাণ ফিরে পাবে। এই সময়ে কৃষি বাণিজ্যে ও শিল্পকলার প্রভূত বিকাশ হয়। মিশরীয়রা জীবতদশায় সমাধি মন্দির তৈরী করে রাখতো। মৃতদেহ যাতে বিকৃত না হয় সেজন্য ঔষধ ও মমি করে লাশ রাখা হতো। কফিনের ওপর মৃত ব্যক্তির মুখোশ করে লাখা হতো। সমাধি মন্দিরের দেয়ালে দাস শিল্পীরা রাজা-সম্রাট দেবদেবী ও নারী পুরুষের উৎকীর্ণ রীতিতে ছবি একেঁ রাখা হতো। মিশর মেসোপটেমিয়, গ্রীক, রোমান, চীন, স্টার আইল্যান্ড পলিনেশিয়া ভারত প্রভৃতি দেশে মূর্তি বানানোর প্রচলন ছিল। আর সম্রাট-সম্রাজ্ঞিদেব-দেবী উচ্চ বংশীয় যোদ্ধা ও দাস-মালিকদের শৌর্য-বীর্য ও অহংকারকে স্থায়ীরূপ দিতেই প্রতিকৃতির সূচনা হয়েছিল। তখন ব্যক্তি শিল্পীর কোন পরিচয় ও স্বাধীনতা ছিল না ই; ইউরোপীয় রেণেসাঁস পরবর্তী সমকাল পযর্ন্ত স্বধীন শিল্পী পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। তার আগে শিল্পীরা ধর্মীয় অনুশাসনে শিল্প রচনা করতো। রেণেসাঁস পরবর্তী আধুনিক যুগে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিকৃতি ও আত্ম-প্রতিকৃতি অঙ্কনকে সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে বেচে নেন।
প্রতিকৃতি ভালোবাসে না এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে হয়তো খুবই কম। প্রতিকৃতি আঁকার প্রয়োজনীয়তাই বা কেন ? এরও সঠিক তথ্য-উপাত্য আমাদের জানা নেই, তবে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় মন:স্তাত্বিক আর শিল্প বোদ্ধাদের কাছে নন্দনতাত্ত্বিক।
যতটুকু ইতিহাসের নিদর্শন থেকে জানা যায় এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের। মিশরীয়দের ধর্মবিশ্বাস ছিল হাজার বছর পরে হলেও একদিন মৃত মানুষ প্রাণ ফিরে পাবে। তাদের সভ্যতা বিকাশ হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। এই সময়ে কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পকলার প্রভূত বিকাশ হয় । সে সময়ে মন্দির, সমাধি-সৌধ নিজস্বতা লাভ করে। তাদের ছিল, রাজপরিবার, ভূমিদাস ও পুরোহিত। মিশরের ধনাঢ্য ও রাজ বংশীয় লোকেরা জীবতদশায় নিজের কবর তৈরী করে রাখতো এবং মৃত দেহ যাতে বিকৃত না হয় সে জন্য ঔষধ ও মমি করা হতো। কফিনের ওপর মৃত ব্যক্তির স্বর্ণের মুখোশ করা হতো। সমাধি-মন্দিরের দেয়ালে দাস শিল্পীরা রাজা-রাণীর, দেবদেবী ও নারীপুরুষের ছবি, মধ্যপলীয় উৎকীর্ণ রীতিতে একেঁ রাখা হতো। ভ্যানগগ মিশরীয় শিল্প সম্পর্কে তার ভাই থিওকে এক চিঠিতে বলেছিলেন-‘যখন চিত্রশিল্পে এক ধরণের নিয়ম থাকে যে, (মানুষ হোক বা নিসর্গ দৃশ্যই হোক) এভাবে বা এরকম করে’প্রকাশ করতে হবে এবং যখন তা সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠবে তখন সেটি আর নিয়ম থাকে না সেটি একটি স্টাইলে পরিণত হয়’।
গ্রীক শিল্পকলার ইতিহাসে পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্য শিল্পের মৌলিকত্ব গড়ে ওঠে। তাদের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য অনেক আবেদন সৃষ্টি করতো। গ্রীকে জন্ম নিয়েছিল পৃথিবী বিখ্যাত অনেক ভাস্কর। গ্রীক শহর ছিল যেমন- পার্থেনন ও ইরেকথিওনের মন্দির ঐতিহাসিক প্রাচুর্য্যপূর্ণ।। গ্রীকদের ঈশ্বরের ধারণা ছিল না, দেবদেবীর ধারণা ছিল মানুষের মতোই সাধারণ।
গ্রীক শিল্পকলার ইতিহাসে পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্য শিল্পের মৌলিকত্ব গড়ে ওঠে। তাদের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য অনেক আবেদন সৃষ্টি করতো। গ্রীকে জন্ম নিয়েছিল পৃথিবী বিখ্যাত অনেক ভাস্কর। গ্রীক শহর ছিল যেমন- পার্থেনন ও ইরেকথিওনের মন্দির ঐতিহাসিক প্রাচুর্য্যপূর্ণ।। গ্রীকদের ঈশ্বরের ধারণা ছিল না, দেবদেবীর ধারণা ছিল মানুষের মতোই সাধারণ। তারা এ-ও বিশ্বাস করতো দেবতাদের সঙ্গে মনুষের বৈবাহিক সর্ম্পক হতে পারে এবং সন্তান হবে ডেমিগড। দেবতা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে মনে করতো না। এমনকি জিউসও নয়। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ছিল- শক্তি, জ্ঞান ও অমরত্বেই দেবতা পৃথক অন্য সবই মানুষের মতো।
আর এই প্রতিকৃতি প্রথম কোথায় অঙ্কন ও নির্মাণ করা হয়েছিল তার সঠিক প্রমান নেই। তবে ধারণা করা হয় যে, প্রথমে দেব-দেবী, উচ্চবংশীয় যোদ্ধা, রাজপুত্র, সামন্ত প্রভুদের প্রতিকৃতি নিমার্ণ করা হতো। তারা মৃতের পরেও প্রতিকৃতি নির্মাণের মধ্যদিয়ে দাসমালিক হয়ে থাকতে চাইতো। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, দেব-দেবী, উচ্চবংশীয় যোদ্ধা ও মৃত দাসমালিকদের শৌর্য-বীর্য ও অহংকারকে স্থায়ী রূপ দিতেই প্রতিকৃতি নিমার্ণে প্রচলন হয়। প্রতিকৃতি নির্মাণের স্থায়ী-মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল প্রাকৃতিক উপাদান- লাইমস্টোন, ব্যাসল্ট , ডেলেরাইট, মার্বল, কাঠ, তাম্রযুগে পিতল, তামা, র্স্বণ, লাইমব্লাস্টার, পরবর্তীতে মোজাইক, মাটি, রঙ ইত্যাদি। সে সময়ে দাসশ্রমিক শিল্পীরা একটি মাধ্যমের মধ্যে প্রতিকৃতি নির্মাণে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এসব প্রতিকৃতি নির্মাণ প্রায় পাচঁ হাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়ে এর ব্যাপিÍ লাভ করে সমকালিন পর্যন্ত। সময়ের কালক্রমে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রতিকৃতির মাধ্যম খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত আছে…। অতীতে কোন মানুষ বা পশুর অবিকল আদল দিতে পারাটাই ছিল, একজন বড় শিল্পীর পূর্বশর্ত। এভাবেই শুরু থেকে হাজার হাজার বছর অতিক্রম করেছে। এই প্রক্রিয়া মিশর, মেসোপটেমিয়া, গ্রীক, রোমান, চীন, ষ্টার আইল্যান্ড দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পলিনেশিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে বিদ্যমান ছিল।
প্রতিকৃতি নির্মাণে রাজতন্ত্র ও সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিকৃতির শিল্পনৈপূণ্য এবং নান্দনিক উৎকর্ষতা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হতে থাকে । পরবর্তীতে এই ধারাবাহিকতা আধুনিক যুগে এসেও প্রতিকৃতি ত্রি-মাত্রিক ও দ্বি-মাত্রিক রূপে এক নান্দনিক মাত্রা পায়। ইউরোপে যখন রেণেসাঁস এর ফলে শিল্প-সাহিত্য নাটক স্থাপত্য ধর্মীয় কটুর আবরণ থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও শিল্প-আন্দোলন দানা বাধেঁ ও বৃটেনে ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল শিল্পবিপ্লব বিস্তার লাভ করে, তখন থেকেই স্বাধীনভাবে শিল্পীরা প্রতিকৃতি ও আত্ম-প্রতিকৃতি অঙ্কনে ও নির্মাণে মনোযোগী হয়ে ওঠে। প্রথমে বাস্তবধর্মী প্রতিকৃতি আঁকলেও পরবর্তীতে ফেমাস শিল্পীরা আত্ম-প্রতিকৃতির নানান সৃজনশীল রূপ দিতে থাকেন। এই সব দাসশ্রমিক শিল্পীরা নিজেদের নাম-পরিচয় লেখার অধিকার তাদের ছিল না। তবুও দাসশ্রমিকদের শ্রম ও ঘামে তিলে তিলে বিশ্বব্যাপি মানব সভ্যতা সুন্দর থেকে সুন্দরতর রূপে গড়ে ওঠেছে…।
শবাধারে ওপরে মৃত সম্রাট ফারাওন তুতেনখামেনের স্বর্ণের প্রতিকৃতি নির্মান করা হয়েছে। প্রতিকৃতিতে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে কপালে সাপের মূর্তি, হাতে রাজদণ্ড ও চাবুক। ভাস্কর্যটি অত্যান্ত ডেকোরেটিভ। এভাবেই সম্রাট দেবতার আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে নিজেকে ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্যমে চির স্মরণীয় করে রাখছে। মিশরের সম্রাজ্ঞী নেফারতিতি রাজ পোষাক পরিহিত প্রতিকৃতি ভাস্কর্য খ্রি.পূ. ২য় সহস্রাব্দ, লাইমস্টোন-রঙিন।
প্রাচীন প্রতিকৃতি ভাস্কর্যের নান্দনিকতা সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরছি- ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে লাইমস্টোনে গড়া ‘রাজপুত্রের একটি বাস্তবানুগ প্রতিকৃতিটির চুল হেলমেটসাদৃশ্য আটোসাটো অবস্থায় আবৃত। প্রতিকৃতিটি বাস্তবানুগ চেহারা স্মিত হাসিযুক্ত প্লাষ্টিক ডাইমেনশন চমৎকার রূপে ফুটে ওঠেছে। এর নান্দনিক গুরুত্ব আধুনিক কালের সমতুল্য। এটি ইজিপশিয়ান জাদুঘর, কায়রোতে সংরক্ষিত আছে। লাঠিহাতে দণ্ডায়মান অবস্থায় ‘শেখ আল বেলাদ’র পূর্ণদেহ প্রতিকৃতি ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব- কাঠ, এই ভাস্কর্যটি ইজিপশিয়ান জাদুঘর, কায়রোতে সংরক্ষিত আছে। এই ভাস্কর্যটি সম্মুখপানে দৃঢ়তার সহিত পদক্ষেপের ইঙ্গিত মেলে। দাসশ্রমিক শিল্পীরা কতটা অনুপাত জ্ঞান সম্পন্ন তার পরিচয় পাওয়া যায় এই ভাস্কর্যে। ২১৫০ খ্রি.পূ গুডিয়ার প্রতিকৃতি ফাইন আর্টস মিউজিয়াম, বোস্টন-এ সংরক্ষিত আছে। রাজ্যপাল গুডিয়া নকশাকৃত ক্যাপ পরিহিত ভাস্কর্যটি কঠিন মসৃণতায়- অভিজাত সরলতা ও প্রসারিত দৃষ্টির মধ্যে জ্ঞান ও স্বপ্ন দ্রষ্টার আবাস পাওয়া যায়।
রাজা সেফরেন-এর বসা অবস্থায় পূর্ণদেহ ভাস্কর্যটি গৌরব ও দাম্বিক শাসকের দৃঢ়তারই প্রতিচ্ছবি। এভাবেই তারা ভাস্কর্য়ের মাধ্যমে নিজের বীরত্ব ও অহংকারকে মূর্ত করে রাখতে চেয়েছে। সেফরণের ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাল ২৫৩০খ্রি.পূ.ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম,কায়রো-তে সংরক্ষিত আছে।
আক্কাদিয়ান রাজার প্রতিকৃতিটি ব্রোঞ্জে নির্মিত অসাধারণ একটি প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। এটি নির্মিত ২৩৭১-২৩১৬ খ্রি.পূ. বর্তমানে ইরাক মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে। এই প্রতিকৃতিতে বাস্তবানুগ অভিব্যক্তি শিল্পানুগ শিল্পনৈপূণ্য ফুটে ওঠেছে চমৎকার রূপে। বিশেষ করে রাজার ব্যক্তিত্ব চাঁপা হাসি দক্ষতার সহিত মডেলিং-এ অভিব্যক্তি অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। শিল্পী প্রতিকৃতিতে নান্দনিক বৈচিত্র্য আনায়নের জন্য দাড়ি টুপি কপালে ও চুলের পিছনে ঝুটি এমনভাবে জ্যামিতিক নকশা দৃশ্যায়িত করেছে যা আধুনিক যুগেও এমনটি সাধারণত পরিলক্ষিত হয় না। দাড়িতে রশিসাদৃশ্য বেনী ও কুমিরের গায়ের ন্যায় উঁচু উচুঁ নকশা এবং বেণীর সাড় যেন মুগ্ধ-নয়নে দেখার জন্য ভাস্কর্যের আহবান।
‘রূপক ভাস্কর্য’ ফ্রান্সে গ্রোটেল ডিপ্যাপ অঞ্চলে পাওয়া যায়-২২০০০ খ্রি.পূ.,মাধ্যম আইবোরি। এই ভাস্কর্যের গড়ন অবিকল মানুষের আকৃতি অনুকৃত হয়। চুল চৌকাকৃতির সারিসারি নকশায় কাপরের ভাজ অলংকরণ করা । মানুষ যাযাবর জীন পরিহার করে যখন কৃষিভিত্তিক জীবনে জন্ম নেয় নতুন বিশ্বাস। পুরোপালীয় যুগের তৃতীয় পর্যায়ের ভাস্কর্যে মানুষের আদল কিছুটা সুবিন্যস্ত ও অলংকৃক দেখা যায়।
ফারাওন তুতেনখামেনের স্বর্ণ-নির্মিত শবাধার, খ্রি.পূ. ২য় সহস্রাব্দ। শবাধারে ওপরে মৃত সম্রাট ফারাওন তুতেনখামেনের স্বর্ণের প্রতিকৃতি নির্মান করা হয়েছে। প্রতিকৃতিতে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে কপালে সাপের মূর্তি, হাতে রাজদণ্ড ও চাবুক। ভাস্কর্যটি অত্যান্ত ডেকোরেটিভ। এভাবেই সম্রাট দেবতার আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে নিজেকে ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্যমে চির স্মরণীয় করে রাখছে। মিশরের সম্রাজ্ঞী নেফারতিতি রাজ পোষাক পরিহিত প্রতিকৃতি ভাস্কর্য খ্রি.পূ. ২য় সহস্রাব্দ, লাইমস্টোন-রঙিন। লম্বা গলার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রাজ মুকুটটি পরিহিত, রাণীর এমন মার্জিত ও দৃষ্টিনন্দন রূপ অভিজাত অলংকরণে দাসশিল্পী তার প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে। এই মুখমণ্ডলটি বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে অসাধারণ এক দৃষ্টান্ত।
(চলবে…)