বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৭, ২০২৫

বেলা শেষের দর্শন

বেলা শেষের দর্শন

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার লাউঞ্জ কিম্বা ক্লাবে বয়সভেদে শিক্ষকদের গল্পকথার মাঝে এক অদ্ভুত রকম প্রকরণ লক্ষ্য করবেন। কোন বয়সের শিক্ষকরা কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন তা দূর থেকে অনায়াসে বলে দেওয়া যাবে। বয়সের বৈচিত্রভেদে গল্পের তারতম্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি বলা যায় নবীন থেকে শুরু করে অবসরে যাওয়া প্রবীণতম শিক্ষকরা পর্যায় বিশেষে কি নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করেন। খুব সঙ্গত কারণেই চোখ বুজে বলে দেয়া সম্ভব বয়সভেদে সেখানে কী কী আলোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা যে শুধু শিক্ষকদের মধ্যে ঘটে তা না, বাড়ির পাশের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কর্পোরেট  অফিসের রেস্ট্রুরেন্ট পর্যন্ত সব জায়গায় মানুষের গল্প করার বিষয়বস্তু বয়সেরর কম ফেরে ভিন্নভিন্ন হয়ে থাকে। হাল আমলে গ্রামে গঞ্জে চায়ের টং-এও এই সব আলোচনা-খোশ গল্পে মানুষ মশগুল থাকে। তবে সন্দেহ নেই এই সব আলোচনার সবচেয়ে পরিকাঠামোগত সংবেদনশীল এলাকা শিক্ষক সমাজের গোল টেবিল। তবে যেখানেই যে গল্প হোক না কেন, নবীনের সাথে প্রবীণের বিরোধটা থাকবেই। সেটা যে সব সময় প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ব্যাপার তা নয় বরং একটা সাংস্কৃতিক বোধের বিপুল ফারাক দুই প্রজন্মের মাঝে দুরত্ব তৈরি করে। নিরুপমার বাবা রাম সুন্দর মিত্র রায় বাহাদুরের ছেলের সাথে দশ হাজার টাকার পণে যখন মেয়ে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেন তখন এই বিপুল টাকা না জুটার ফলে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হল। নিরুপমার শ্বশুরের অমানবিক আচরণ দেখে হবু বর বাবার প্রতি অবাধ্য হয়ে বললেন, “কেনাবেচা-দর দামের কথা আমি বুঝি না; বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইব”। ছেলের এই অবাধ্যপনায় বাবা বলল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার?” দুই একজন প্রবীণ বলে ফেলল, “শাস্ত্র শিক্ষানীতি শিক্ষা একেবারেই নাই, কাজেই।“ (দেনা পাওনা, রবীন্দ্রনাথ)। এইশাস্ত্র শিক্ষা বা নীতি শিক্ষার ব্যাপারটায় একটু পরে আসি। তার আগে দেখে নেয়া যাক, আদতে নবীন- প্রবীণের ভাবনার মূল জায়গাটা কী!


সেই সমাজে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষের খোঁজে সক্রেটিস নাকি নেমেছিলেন। বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বললেন,যেমন রাজনীতিবিদ, কবি, কারুশিল্পী ইত্যাদি। এদের মধ্যে কারুশিল্পীদের কাজের দক্ষতায় মনে হয়েছে তারাই বুঝি সবচেয়ে জ্ঞানরাখেন। কিন্তু সক্রেটিস মনে করছেন কারুশিল্পীদের যতই দক্ষতা থাকুক না কেন সেটা একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে


লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নবীন শিক্ষকরা তাঁদের প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি, বিভিন্ন দেশের সাথে তাঁদের বেতনের তুলনামুলক বৈষম্য, বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংরকিং কী, বিদেশে পাড়ি জমানো, অথবা তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অন্য কোন লোভনীয় চাকরিতে না যাওয়ার আক্ষেপ,ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক ঝড় তোলেন,মন খারাপ করেন, বিসিএস পরীক্ষা না দিয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের জন্য প্রমাদ গোনেন, আবার আরেক্টু বয়স বাড়লে উচ্চপদেস ঠিক সময়ে না যাওয়ায় বঞ্চিত হওয়া নিয়ে তিরস্কার, প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ, সহকর্মীর প্রতি ঈর্ষা-অনুযোগ, গবেষণাপত্র লেখা-না লেখা নিয়ে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি। মাঝ বয়সে বাড়ি, গাড়ি, ফ্লাট, সন্তানের লেখাপড়া, দেশের রাজনীতি, ক্ষমতা, এই সব। আর অবসরে যাওয়া বয়স্ক শিক্ষকরা নিশ্চিতভাবে শরীরের অবস্থা- ডায়াবেটিস, হার্ট, উচ্চরক্তচাপ, চোখ, কিডনি, ছেলেমেয়ের অবস্থান, স্ত্রীর রোগ-বালাই, নাতি-নাতনি,, এসব বিষয় নিয়ে অনেকটা পড়ন্ত সূর্যের মতো নিষ্প্রভ আলোচনা করতে করতে চিনি ছাড়া চা খেয়ে যে যার মতো পথ হাঁটেন। তবে উল্লেখ থাকে যে, উপরের সবক্ষেত্রে আলোচনার একটা কমন এজেন্ডা তো থাকেই তা হল রাজনীতি, অর্থনীতি, আর দেশের ভবিষ্যৎ।
প্রশ্ন হল, দিন শেষে মানুষের বয়সের ভার যখন কাবু করে ফেলে তখন তার ভাবনা কী দাঁড়ায়? তখন কতটুকু তার জীবনের জন্য দরকার হয়, কিম্বা সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি নিজের সংসারের কাছেই বা কতটুকু এই মানুষের মুল্য থাকে? এসব চিন্তা নিয়ে যে কেউ ভাবেনি তা না। বরং আমাদের যাপিত জীবনের বড় একটা অংশ এ সব আলোচনা-সমালোচনায় ভরপুর থাকে। দর্শনের ছাত্র হিসেবে এই ভাবনার একটা কাঠামো নিরূপণ করা বোধ করি বেমানান কিছু হবে না। এখানে আমরা দেখবো প্রাচীনকাল থেকে কিভাবে এই চিন্তাগুলোর বিবর্তন হয়েছে দার্শনিকদের হাতঘুরে।
সম্ভবত প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে প্লেটো সবার আগে এ ধরণের ভাবনার অবতারণা করেন। বয়স্ক মানুষের প্রজ্ঞা নিয়ে তাঁর আস্থা ছিল বিস্তর যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তাঁর অধিবিদ্যক, ও জ্ঞান তাত্ত্বিক অনুকল্পে। “এপলজি”-তে আমরা দেখি, সক্রেটিসের বয়স ৭০ এবং তিনি সে সময়ের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। প্লেটো নিশ্চিত হয়েছেন যে সক্রেটিস সব মানুষের মধ্যে    সবচেয়ে জ্ঞানী তথা প্রাজ্ঞ। তাঁর বন্ধু চেয়ারেফন( Chaerephon) ডেলফির কাছ থেকে এক দৈববাণী পেয়েছিলেন যে, সক্রেটিস সন্দেহাতীতভাবে একজন অসামান্য প্রাজ্ঞ মানুষ। সক্রেটিস নিজে এমন ধরণের কথা বলেন নি, বরং বলেতেন তিনি জানেন যে তিনি কিছু জানেন না। সেই সমাজে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষের খোঁজে সক্রেটিস নাকি নেমেছিলেন। বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বললেন, যেমন রাজনীতিবিদ, কবি, কারুশিল্পী ইত্যাদি। এদের মধ্যে কারুশিল্পীদের কাজের দক্ষতায় মনে হয়েছে তারাই বুঝি সবচেয়ে জ্ঞান রাখেন। কিন্তু সক্রেটিস মনে করছেন কারুশিল্পীদের যতই দক্ষতা থাকুক না কেন সেটা একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে। যার ফলে সক্রেটিস এপলজিতে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, শুধু নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কোন বিশেষজ্ঞানের অধিকারী হলেই তাঁদেরকে জ্ঞানী বলা সমীচীন হবে না। সে দিক দিয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধ সক্রেটিসের কোন তুলনাই হতে পারে না। কিন্তু কেন? বিশেষ বা নির্দিষ্ট বিষয় কেন সক্রেটিসের কাছে ধর্তব্য নয়। কেন সার্বিক ধারণার ওপর তাঁর এত বিশেষ আগ্রহ। এর উত্তর প্লেটোর রিপাবলিকে আমরা পাই তাঁর সার্বিকতার ধারণা থেকে। যেমন ধরুন, আমাদের বাসার বিড়াল হয় কালো, নয় সাদা, শিকারি, প্রভুভক্ত, লোমশ, দেশী, অথবা টার্কিশ ইত্যাদি। কোন বিড়ালের সাথে কারো মিলনেই। না মিল আছে আচরণে, না মিল চেহারায় না আছে খাদ্যভাসে। তারপরেও প্রত্যেকেই বিড়াল। এর অর্থ বিড়ালত্ব বলে যে ধারণা আমাদের মনের ভেতর আছে সেটা কোন খণ্ডিত বা বিশেষ কিছু নয়। বরং সার্বিক যা কিনা সামগ্রিক“আকার”।


তাঁর মতে নৈতিক সৌকর্যের সবচেয়ে ভালো সময় মাঝ বয়স।বৃদ্ধ বয়স বহুলাংশে কাপুরুষচিত, অধিক্ষিপ্ত, অচল, আর বাচালতাইপূর্ণ। অতীতে নিয়ে টানা হেঁচড়া করা বৃদ্ধ বয়সের অভ্যাস। বয়সের ক্ষয়িষ্ণুতা যেমন তাঁদেরকে ঘিরে ধরে, মননেরও পরেও পড়ে ঝুল কালি। এরিস্টটল তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থ রিটরিক-এ লিখছেন, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিলয় ঘটে।কারণ বৃদ্ধ বয়সে কারো কিছু করার থাকে না, মানুষ শুধু অতীতের অর্জন নিয়ে হাপিত্যেশ করতে থাকে। বৃদ্ধরা সমাজের জন্য একটা বড় দায়!


এবং সাথে সাথে মনে রাখতে হবে এই সার্বিক   ধারণার জায়গা বস্তুর বাইরে। অর্থাৎ বস্তুর বিলয় ঘটলেও ধারণার কোন শেষ নেই—ন হন্যতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সার্বিক ধারণার সাথে প্রাজ্ঞ বা বৃদ্ধ দর্শনের সম্পর্ক কী? এর উত্তর আমরা প্লেটোর কাছ থেকেই পেয়েছি, তিনি ফিডো-তে লিখছেন, মানুষ যখন বয়সের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে তখন তাঁর কাছে নিচের ছোট, বড়, কালো, সাদা, লম্বা, খাটো ইত্যাদি সমান দেখায়। অর্থাৎ,“ আমার চোখে তো সকলই শোভন,/ সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,/বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।“আমরা যখন প্লেনে উঠি, উড়াল দেবার প্রতি মুহূর্তে নিচের স্থাপনাগুলো ছোট দেখাতে থাকে। এক সময় নিচের হাজারো বৈচিত্রময় মর্তলোক সব একাকার হয়ে যায়। এজন্যই প্লেটো সক্রেটিসের বরাত দিয়ে এপলজিতে বলতে চেয়েছেন, ক্রমবর্ধমান বয়সে মানুষ তার সঠিক বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয় এক মাত্র পূর্ণ বয়সেই এইভেদ বুঝতে পারে। এজন্য মৃত্যু মন্দের কিছু নয়। মৃত্যুর দিকে ধীরেধীরে এগিয়ে যাওয়াও অর্থই হচ্ছে পূর্ণতাপ্রাপ্তি।[Only the gods and, perhaps, the dead have true wisdom. If the dead have such knowledge, then perhaps death isn’t an evil after all (Apology, 40b-42a).]সম্ভবত এরই এক অনিবার্য কাব্যিক রূপ আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে, “তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই–/কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই॥“
এরিস্টটল বৃদ্ধ মানুষের জীবনকে ঠিক এর উল্টো ভাবে দেখেছেন। তিনি বলছেন, বৃদ্ধ মানুষেরা পরিত্যক্ত, নিষ্ক্রিয়, পরাজিত, অকর্মণ্য, অধিক্ষিপ্ত এবং ভাঙা ও ধসকা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বহুবছরের পুরনো অট্টালিকার মতন। তাঁরা পুরনো কথা নিয়ে বেঁচে থাকেন, চর্বিতচর্বণ করতে করতে নতুন কিছু আর থাকে না। স্মৃতিচারণই তাঁদের একমাত্র সম্বল।তাঁরা প্রায়শই বাচাল হয়ে থাকেন, এবং অতীত নির্ভরতা নিয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে আশে পাশের শ্রোতা হারিয়ে ফেলেন। শরীরে যেমন তাঁরা ক্ষীণ হয়ে উঠেন তেমনি মনের মাঝেও বাসা বাধে এক অস্পষ্ট র্দৌবল্য। কাজেই বৃদ্ধদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু দেবার থাকেন না। দেবার থাকে না পরিবারেরও। এ কারণেই বৃদ্ধরা, তাঁর ভাষায়, সোসিওপ্যাথিক।
তাহলে কোন বয়স শ্রেষ্ঠ?এর উত্তর পাওয়া গেছে তাঁর‘নিকমেকিয়ান এথিকস’ গ্রন্থে। তাঁর মতে নৈতিক সৌকর্যের সবচেয়ে ভালো সময় মাঝ বয়স।বৃদ্ধ বয়স বহুলাংশে কাপুরুষচিত, অধিক্ষিপ্ত, অচল, আর বাচালতাইপূর্ণ। অতীতে নিয়ে টানা হেঁচড়া করা বৃদ্ধ বয়সের অভ্যাস। বয়সের ক্ষয়িষ্ণুতা যেমন তাঁদেরকে ঘিরে ধরে, মননেরও পরেও পড়ে ঝুল কালি। এরিস্টটল তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থ রিটরিক-এ লিখছেন, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিলয় ঘটে।কারণ বৃদ্ধ বয়সে কারো কিছু করার থাকে না, মানুষ শুধু অতীতের অর্জন নিয়ে হাপিত্যেশ করতে থাকে। বৃদ্ধরা সমাজের জন্য একটা বড় দায়! এরিস্টটল তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ যেমন“ অনইওথএন্ডওল্ডএইজ”, “অন লাইফ এন্ড ডেথ”, “অন ব্রেথিং”ইত্যাদি গ্রন্থে এই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি আরও লেখেন বৃদ্ধরা হয়ে পড়ে সস্তা আর বিরক্তিকর যারা শুধু সারাক্ষণ নিজের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, নিজের গুণগান করতে থাকেন, এবং নিজের ভালো ছাড়া অন্যকে পাত্তা দেন না। এ কারণে তিনি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন, জীবনের মধ্যম বয়সই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এ যেন হেলাল হাফিজের কথা, “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”। এরিস্টটল তাঁর এই মধ্যম পন্থার একটা গাল ভরা নাম দিয়েছেন, গোল্ডেনমিন। গোল্ডেনমিন মানে হল‘না ঘরকা না ঘটকা’। মানুষের নৈতিকতার কোন চরমতম পন্থা যেমন পরিহার্য তেমনি বয়সের পরিক্রমায় দুই প্রান্তিক বয়সও পরিত্যাজ্য। মানুষ জন্ম থেকে কোনো সুকুমার বৃত্তি নিয়ে আসে না আবার শেষব য়সেও এই বৃত্তির অবশেষ থাকে না। মানুষ এই সমাজ থেকে সুন্দর, মানবিক, ও মননশীল বৃত্তি অর্জন করে। মানুষের চরিত্র গঠিত হয় ধীরে ধীরে অভ্যাসের নিরন্তর কর্ষণের মধ্য দিয়ে। আমরা যতই পরিশুদ্ধতার মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালিত করবো ততই আমরা সমাজের কাঙ্ক্ষিত মঙ্গলের দিকে ধাবিত হব। মনে রাখতে হবে, মধ্যম পন্থা যেমন জীবনের জন্য জরুরী তেমনি মধ্য বয়সও সারা জীবনের মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।
মার্কাস টুলিয়াসসিসেরো ছিলেন খুবই নাম করারোমান দার্শনিক। দর্শনের বাইরেও তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তাঁর ঘটনাবহুল আলোকিত জীবনের নানান গল্প দার্শনিকদের মাঝে বহুচিন্তার জন্ম দিয়েছে। De Senectute বা‘ অন ওল্ড এজ’ নামে তিনি ছোট্ট একটা বই লেখেন। এই বইয়ে তিনি প্লেটোর মতন বৃদ্ধ মানুষের চিন্তার উৎকর্ষতা নিয়ে দারুণ অকাট্য যুক্তি দেখান। অন্তত চারটি যুক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি বৃদ্ধদের নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক বক্তব্যের জবাব দেন। প্রথম যুক্তিতে বলেন, মানুষ মনে করে বৃদ্ধ হলে বয়সেরভারে শরীর অসাড় হয়ে পড়ে, কোন উদ্দীপনা, থাকে না কর্মস্পৃহা। সিসেরো বলেন, মানুষের কাজ শুধু শরীর দিয়েই হয় না, চিন্তা বা মস্তিষ্কের কাজই সবচেয়ে বড়। মানুষ পরিণত বয়সেই মস্তিষ্কের কাজ করে থাকে দক্ষতার সাথে। মানুষের কাজের মূল্যায়ন হয়ে থাকে কাজের ফলাফল বা পরিণতিরও পর। কিছু সময় দেখা যায়, অত্যন্ত ছোট্ট একটা সিদ্ধান্তের জন্য বিরাট একটা ইতিবাচক ফলাফল আসতে পারে। সিসেরো-র নিজের কথায়,

Those, therefore, who allege that old age is devoid of useful activity adduce nothing to the purpose, and are like those who would say that the pilot does nothing in the sailing of the ship, because, while others are climbing the masts, or running about the gangways, or working at the pumps, he sits quietly in the stern and simply holds the tiller (De Senectute, vi. 17)
বৃদ্ধরা পরিণত বয়সে যে সিদ্ধান্ত দেন, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন যুবকরা। সিসেরোর সমর্থনে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, পৃথিবীর সবদেশে ভোট প্রদানের অধিকার একটি নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম করেলেই কেবল অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ভোট প্রদানের সর্বোচ্চ বয়সের কোন সীমা নেই। এর অর্থ মানুষের প্রাজ্ঞতা বা বিবেচনা শক্তির কোন এক পায়ারিডেট থাকে না। প্লুটার্ক এই কথাটার সমর্থনে বলেন, যারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন তারাই বয়স্ক ও জ্ঞানী মানুষ অন্য দিকে অধিকতর কম বয়সের মানুষেরা সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে থাকেন। প্লুটার্ক জীবনের গুরুত্ব নিরূপণ করতে গিয়ে আরও মুল্যবান একটা কথা বলেছেন, যে সমাজের মানুষ শুধু অর্থ উপার্জন এবং গৃহস্থলীর মতো শারিরিক কাজে ব্যস্ত থাকে সে সমাজে অবক্ষয় অনিবার্য।
সিসেরো তাঁর দ্বিতীয় যুক্তিতে বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বৃদ্ধরা শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল আর কৃশকায় হয়ে থাকেন। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, শারীরিক শক্তির পাল্লায় হাতী কিম্বা ষাঁড় অনেক এগিয়ে। তার অর্থ মানুষের চেয়ে ষাঁড়ের গুরুত্ব বেশি হবে? নিশ্চয় নয়। তৃতীয় সমালোচনার জবাবে সিসেরো বলেন, এটা ঠিক বৃদ্ধ বয়সে মানুষের শারীরিক সুখ যুবকদের মতো এত আনন্দঘন হয় না। কিন্তু এটা তো ঠিক শারীরিক চাদিহা যদি না থাকে তাহলে সে নিজেকে বঞ্চিত কেন ভাববে? কেউ তখনই নিজেকে বঞ্চিত ভেবে ফেলে যখন সে নিজের থেকে কোন কিছু পাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। যার ইচ্ছেই নেই তাঁর আবার বঞ্চিত হবার কি আছে? সিসেরো সর্বশেষ সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন এভাবে, বৃদ্ধ বয়স আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যতটা বৃদ্ধ হয় মানুষ ততটাই সে মৃত্যুর কাছে চলে যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ কি শুধু বৃদ্ধ হলেই মরে? যুবকেরা মরে না? যুবক বয়সে মৃত্যু আর বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর ভেতর তফাৎ হল বৃদ্ধ বয়সের মৃত্যু জীবনের বহু অভিজ্ঞতার পরিণতির সুনির্দিষ্ট ফলাফল। অন্য দিকে যুবদের মৃত্যু যেন, “যে ফুল না ফুঁটিতে ঝরেছে ধরণীতে যেন দীমরু পথে হারাল ধারা/ জানি হে জানি তাও হয়নি সারা”।
এসব আলোচনা থেকে আমরা ঠিক বুঝতে পারি না, মানুষের কোন বয়সটা সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত। কোন বয়সটা সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। কারণ এ নিয়ে সন্দেহাতীতভাবে কোন দার্শনিকই একমত হতে পারেনি, পারেনি সাধারণ মানুষও। সারা জীবন সব প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ একজন মৃত্যু পথযাত্রী ইতালিয়ান যুবরাজ-কে জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁর জীবনে কোন অপ্রাপ্তি আছে কিনা। সে আক্ষেপ নিয়ে উত্তর দিল, একবার একটা সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদে পোপ ও রাজা– দুজনকে পেয়েছিলাম একসাথে। আজও অনুতাপ করি, দুজনকেই সেদিন যদি ওখান থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম, তাহলে চিরজীবন অন্তত কুখ্যাত হয়েও ইতিহাসের পাতায় থেকে যেতাম। মানব জীবনের কী অদ্ভুত মনবিক্ষেপ! এর অর্থ কোন সম্পূর্ণ প্রাপ্তিই মানুষকে পূর্ণ করতে পারে না! জীবনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অসীম। সে চায়, আরও চায়। জীবনকে প্রলম্বিত করার বাসনা তার জন্মগত। জীবনের বহমানতার প্রতিটি পর্বের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। উল্টোভাবে দেখলে প্রতিটা পর্বেরই একটা বেদনাও আছে। বেদনা ও আনন্দের একযৌথ সংসার জীবন। খুব ছোট বেলা মিস করেনা এমন মানুষ নেই, স্কুল-কলেজের সুন্দর দিনগুলোর কথা কেউ ভাবে না এমন মানুষ মিলবে না।সারা জীবনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে কেউ সোনালি ফ্রেমে আঁটকে রাখেননি, এমন মানুষ কই? জীবনের আসল সৌন্দর্য কোথায় সেটা বলা সহজ নয়। অশীতিপর বৃদ্ধও স্বপ্ন দেখতে থাকেন আবার তরুণ-যুবকও ভেঙে পড়েন জীবনের ভারে। তবে এটা বোধ করি ভুললে চলবে না যে, জীবনের অর্থ মানুষের কাছে বহুলাংশে অজানা। এজন্য যে বয়সই হোক সব সময়ের, সবমুহূর্তেরই একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। তবে জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে সম্ভবত মানুষকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা উচিৎ। বৃদ্ধ বয়সটা বেলা শেষে পড়ন্ত সূর্যের মৃয়মান আলোর মতো বিভাসিত এক শান্ত বিকেল। ইংরেজ কবি এডমন্ড ওয়েলারের কয়েকটা কথা দিয়ে শেষ করি…
The seas are quiet when the winds give o’er
So calm are we when passions are no more.
or then we know how vain it was to boast
Of fleeting things, so certain to be lost.
Clouds of affection from our younger eyes
Conceal that emptiness which age descries.

লেখক পরিচিতি

সিদ্ধার্থ শংকর জোর্য়াদ্দার
সিদ্ধার্থ শংকর জোর্য়াদ্দার
অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিভাগের আরও লেখা

ফেসবুক পেইজ

বিজ্ঞাপন

spot_img

জনপ্রিয় লেখা

তবু ফুলেরা হাততালি দেয়

মধুপুর যেতে যেতে

চাইনিজ কবিতা

জমে থাকা অন্ধকারের গল্প