যাহিদ সুবহান
ভিন্ন স্বর, ভিন্ন কাঠামো আর নতুন পথ নির্মাণের অক্লান্ত চেষ্টা; প্রসঙ্গ: কবি শফিক সেলিমের কাব্যগ্রন্থ: ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক অব বোর্ড বাজার আইল্যান্ড
কবিতা পৃথিবীর অনিন্দ্য সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ। কবি তাঁর দেখা এবং ভাবনার যতো অসামঞ্জতা, যা পৃথিবীতে আছে, সেগুলো কবিতায় তুলে আনেন; বার্তা দেন। কবিতা কবির যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রতিনিয়ত একজন কবি যে জীবন যাপন করেন তারই উল্লেখযোগ্য লিখে রাখেন কলমের আঁচড়ে; নিজের মতো, সেগুলো কবিতা হয়ে যায়। কবির ভাষা প্রতিবাদের-মানবতার-প্রেমের। কবিতাই কবির মোক্ষম অস্ত্র। কবি তাঁর কবিতা দিয়েই লড়ে যান সকল সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। কবির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। যুগে যুগে কবিতা সংগ্রামের প্রতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই প্রেম-মানবতা কিংবা বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবে সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে কবিতা
বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকেন
আমি মাঝে মাঝে দেখতে যাই
তিনি সুস্থতার অপেক্ষায় থাকেন
আমি তার মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করি
উদ্ধৃত কবিতাংশটি কবি শফিক সেলিমের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক অব বোর্ড বাজার আইল্যান্ড’ এর বাবা শিরোনামের কবিতার অংশবিশেষ। কবিতাংশটুকু সাধারণ দৃষ্টিতে পাঠ করলে মনে হতে পারে একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান পিতার মৃত্যু কামনা করে উষ্মা এবং অবহেলার চরম প্রকাশ করছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। কবিতাটি একজন অসুস্থ পিতার জীবনযন্ত্রনা সহ্য করতে না পারা এক সন্তানের আকুতি। হাসপাতালের বিছানায় বাবা অবিরত অসহ্য যন্ত্রনা ভোগ করছেন আর সন্তান সেই যন্ত্রনাকে অনুভব করে নিজেও ভোগ করছেন অসহ্য যন্ত্রণা। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনে সন্তান বাবার মৃত্যু কামনা করছেন। মূলত বাবার প্রতি সন্তানের অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির এই কবিতাংশ। আর সচরাচর ধারার বাইরে এসে ভিন্ন ভাষায় যে এমন অনুভূতি প্রকাশ করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কবি শফিক সেলিমের এই কাব্যগ্রন্থটি।
একবার অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর প্রিয় ছাত্র ও শিষ্য আহমদ ছফাকে কথায় কথায় বলেছিলেন ভাষাকে মূলত চাষা-ভূষা-সাধারণ মানুষই টিকিয়ে রেখেছে। আহমদ ছফা তাঁর ‘যদ্যাপি আমার গুরু’ গ্রন্থে বিষয়টি আলোচনা কররেছিলেন। কবি শফিক সেলিম তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে সেই সাধারণ মানুষের ভাষার মতো করেই কবিতা রচনা করেছেন। আটচল্লিশ পৃষ্ঠার কবিতার বইটিতে মোট ২৪ টি কবিতা রয়েছে যার প্রায় সব কবিতাই ভিন্ন স্বাদের। ভিন্ন কাঠামোর কবিতাগুলোকে কবি সাজিয়েছেন নিজের মতো। গ্রন্থটির কবিতাক্রমের প্রথম কবিতার শিরোনাম চাওয়ালা। কবিতাটি দারুণ স্যাটায়ারিক। গ্রন্ধটির বেশীরভাগ কবিতাই স্যাটায়ার ধর্মী। হৃদয়গহীন থেকে উৎসারিত প্রতিবাদ সাধারণ ভাষায়; সাধারণের ভাষায় এতো শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করা যায় তা এই কাব্যগ্রন্থটি না পড়লে বোঝা যাবে না। গ্রন্থটির কবিতাগুলো পড়লে মনে হবে ফাল্গুনী রায় কিংবা শৈলেশ্বর ঘোষ নতুন করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে আাদের সামনে হাজির হয়েছেন। শফিক সেলিমকে মনে হতে পারে হাংরি জেনারেশনের প্রতিনিধি কবি। যখন আমাদের দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়, সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার বঞ্চিত ঠিক এই মুহূর্তে কবিতার ভাষায় কবি যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। অনেক লিখিয়েই এতো স্পষ্ট ভাষায় লেখার সাহস করেন না। কবি লিখেছেন-
দুর্নীতি কিচু না
সরল বিশ্বাসে করেন, ক্ষমা পাইবেন
তবে ভুলেও কিন্তু ইচ্চাকিত দুর্নীতি করবেন না
সুযোগ লুইট্যা নেন। দ্যাশ যাইক গুয়া মারা
গালি বা খিস্তি খেউর ভাষার অংশ। খিস্তি খেউর ছাড়া কোন ভাষাই সমৃদ্ধ নয়। খিস্তি খেউর প্রতিবাদের ভাষা। তবে খিস্তি খেউরকে যে শিল্পে পরিণত করা যায় কবি তাঁর এই গ্রন্থে সেটি তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। কবি কতোটা সাম্যবাদী চিন্তা এবং রাজনৈতিক সচেতন তা আমাগো সংবিধান শিরোনামের কবিতা পাঠ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন। মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ছিলো এদেশ সবার হবে; সবাই সমান। সেই চেতনা ধারণ করেই রচিত হয়েছিলো আমাদের পবিত্র সংবিধান। সংবিধানের ২৭ নং আর্টিকেলে এ ঘোষণা করা হয়েছে স্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে আমাদের পবিত্র সংবিধানে চালানো হয়েছে ছুড়িকাঁচি। সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ধকারে বারবার। কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কী সংবিধানের পবিত্র বাণী কোনটিই বাস্তবায়ন হয় নি দেশ স্বাধীনের অর্ধশতাব্দী পরও। এই দেশেকে আইসক্রিমের মতো চুষে চুষে আয়েশী জীবন কাটাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, যারা বিশেষ শ্রেণির। আর এই চরম বাস্তবতার হতাশা থেইে কবি লিখেছেন-
খাড়াইয়া মুততাচি
দেহি, ছেঁড়া বইয়ের পাতা
পাতার উপরে লেহা ২৭ নম্বর আর্টিকেল
উপরে লেহা
বাংলাদেশের সংবিধান
নিম্নবিত্ত শ্রেণির দুর্দশা চিত্রিত হয়েছে তুমি মিয়া আজাইরা শিরোনামের কবিতায়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যখন গলা ফাঁটিয়ে উন্নতির কথা বলেন, নিম্নবিত্তশ্রেণির চরম দুর্দশা দেখে সে হিসেব মেলে না। দ্যাশ বালো চলচে শিরোনামে গ্রন্থের তৃতীয় কবিতাটি চরম প্রতিবাদের কবিতা। কয়েকদিন আগে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন, কিংবা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে অকুন্ঠ সমর্থকন করে এবং দুর্নীতিকে ঘৃণা করে কবি লিখেছেন-
হুদাই পুলাপান রাস্তায় নামে
গাড়ির ফিটনেস নাই
তাতে তুমাগো কি?
সুন্দরবনের বাঘ মরে দূষণে
তাতে তুমাগো কি?
ব্যাংক লুট কইরা কানাডায় বাড়ি বানায় আইনুদ্দিন
তাতে তুমাগো কি?
দেশ তো সোন্দার আচে
কবি শফিক সেলিম সিরিয়াস ধারার কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর কবিতা যাপন দীর্ঘ দিনের। বাংলা সাহিত্যে পড়াশুনা করে তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য পড়ান। তিনি মানুষ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলজন্ম’ অনেকটা রোমান্টিক ধাঁচের হলেও ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক অব বোর্ড বাজার আইল্যান্ড’ গ্রন্থটি পুরোটাই বিপরীত। একজন শিক্ষক হয়েও তিনি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের প্রজন্মকে মেরুদন্ডহীন আজ্ঞাবহ দাস হিসেবে গড়ে তুলছে বলে মনে করেন কবি। গ্রন্থ শিরোনের কবিতাটি পাঠ করলেই তা বোঝা যাবে।
: তর পুলারে কি করবি?
: লেহাপড়া হিকামু, বড়ো চোর বানামু
: তর ম্যায়ারে কি করবি?
: লেহাপড়া হিকামু, বড়ো চোরের কাচে বিয়া দিমু
: আর
: দলে দলে চোর পোডাকশন করুম
বকরি ঈদের চামড়া: গুলিস্তানের জুইত্যা শিরোনামের কবিতাটি দারুণ স্যাটায়ারিক এবং বাস্তব চিত্রপট। সোনার মাকড়ি কবিতাটি পাঠ করলে পাঠক গভীর অনুভুতির বার্তা পাবেন। ছবি কবিতাটি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আত্মার অন্তর্স্থল থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধালিপি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের লোক দেখানো আর মেকি ভক্তির বিপরীতে লোকচক্ষুর আড়ালে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করা এক পরিবারের কথা তুলে আনা হয়েছে। কবি লিখেছেন-
ও কি, বাপ! ও দিকে না
ও দিকে না
এ দিকে ঝোলানো আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি
মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর পরিচয় শুধু মানুষ। কী ধর্ম, কী বর্ণ, কী নাম কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। আপনি একজন মানুষ এবং নাম শিরোনামের কবিতা দুটিতে সে কথাই বলা হয়েছে। সরকার আমিনের সাথে এক কাপ চা কবিতাটি সরকার আমিনের প্রতি কবির ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধার অনন্য নিদর্শন। সরকার আমিন কবি শফিক সেলিমের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করেছেন সেই খবর আমরা সহজেই পেতে পারি।
কবি শফিক সেলিমের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক অব বোর্ড বাজার আইল্যান্ড’ কাব্যগ্রন্থটির বেশিরভাগ কবিতাই শক্তিশালী মনে হয়েছে। কবি এই কাব্যগ্রন্থটিতে তাঁর সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে মনে করি। দারুণ দ্বন্দ-রোমান্টিকতায় ভরা তাঁর কাব্যগ্রন্থটি। কাব্যগ্রন্থটির সকল কবিতাই উত্তরাধুনিক কাঠামোতে রচিত এবং ছন্দের দ্ব›দ্ব লক্ষণীয়। কয়েকটি কবিতাকে গ্রন্থের সাথে মানানসই মনে হয় নি; সাধারণ ঢঙে লেখা। কিছু বানান এবং অপচলিত শব্দের ব্যবহার পাঠককে ধন্দে ফেলে দেবে বলে মনে হয়। বাংলা জার্নাল প্রকাশনের ব্যানারে চাররঙা দৃষ্টিনন্দিত অপূর্ব প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী রাজীব দত্ত। পস্তানির নকশা কাব্যগ্রন্থটিকে বিশেষ বৈচিত্র দান করেছে। কবি এখানে ব্যক্তিগত অধিকার চর্চা করেছেন। গ্রন্থটির অভ্যন্তরীন অঙ্গসজ্জা প্রশংসার দাবী রাখে। বইটির শুভেচ্ছা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৫/- (একশত পয়ত্রিশ টাকা মাত্র)। সব মিলিয়ে কাব্যগ্রন্থটিকে একটি স্বার্থক কাব্যগ্রন্থ বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। ব্যতিক্রম চেষ্টার এই কাব্যকর্ম কবির অক্লান্ত চেষ্টাকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।